বাতাসে ভাসা ভালোবাসা || বাংলা গল্প || কষ্টের গল্প

বাতাসে ভাসা ভালোবাসা
বাতাসে ভাসা ভালোবাসা

মাইনুদ্দীনের সকালগুলো শুরু হতো রিমোর নাম্বারে কল দিয়ে। ফোনের ওপাশ থেকে তার মিষ্টি গলা শুনলেই মনে হতো, পৃথিবীর সব চেয়ে সুন্দর সুর যেন তার কানে বাজছে। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই সুরের মাঝে কেমন যেন একটা অনিশ্চয়তা ভর করতে থাকে।

রিমো এখন আর আগের মতো নেই। একসময় যে মেয়েটা মাইনুদ্দীনের জন্য পাগল ছিল, এখন সে অনেক বদলে গেছে। সবসময় ব্যস্ত, ফোন ধরে না, ধরলেও তাড়াহুড়ো করে কথা শেষ করে দেয়। আর সবচেয়ে বেশি যা মাইনুদ্দীনকে পোড়ায়, সেটা হলো—রিমো এখন অনেক ছেলের সাথে কথা বলে।

মাইনুদ্দীন এটা সহ্য করতে পারে না। তার ভালোবাসা ছিল নিখাদ, একান্ত। সে চেয়েছিল রিমো শুধু তার থাকবে, অন্য কারও সাথে কথা বলবে না, অন্য কাউকে গুরুত্ব দেবে না। কিন্তু রিমোর কাছে এই দাবিটা ছিল হাস্যকর।

— "তুমি আমাকে এত শাসন করো কেন?" একদিন বিরক্ত হয়ে বলল রিমো।

— "আমি শাসন করি না, আমি ভালোবাসি। আর ভালোবাসলে কি একটু এক্সক্লুসিভিটি আশা করা অন্যায়?"

— "ভালোবাসা মানে তো কেবল একসাথে থাকা না, স্বাধীনতা দাও, বিশ্বাস রাখো। আমি কার সাথে কথা বললাম, কার সাথে দেখা করলাম—এসব নিয়ে এত প্রশ্ন করো কেন?"

— "কারণ আমি তোমাকে হারাতে চাই না, রিমো!"

রিমো হাসল, একটু তাচ্ছিল্যের সুরে। "তাহলে নিজেকে পাল্টাও, আমাকে এত বাঁধতে এসো না!"

ঝগড়াগুলো বাড়ছিল। রিমো আগের মতো আর সময় দিত না, আর মাইনুদ্দীন প্রতিদিনই নতুন নতুন ছেলের নাম শুনত তার মুখে।

— "ওহ, তৌহিদ না? হ্যাঁ, সে খুব ভালো বন্ধু।"
— "রিজভী? আরে না, ও তো আমার সাথের কোচিংমেট।"
— "তানভীর? আহা, ও তো কেবল একজন ক্লাসমেট, তুমি এত সন্দেহ করো কেন?"

এভাবে প্রতিদিনই নতুন নতুন ছেলের নাম শুনে মাইনুদ্দীনের হৃদয়ে যেন ছুরির খোঁচা লাগত। সে কষ্টে চুপ থাকত, কিন্তু চুপ থাকলেই তো ব্যথা কমে না।

একদিন মাইনুদ্দীন আর সহ্য করতে পারল না।

— "তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না, রিমো?"

— "এই প্রশ্নটা করছ কেন?"

— "কারণ আমি তোমাকে আর আগের মতো পাই না। তুমি বদলে গেছ।"

রিমো দীর্ঘশ্বাস ফেলল। "বদলে গেছি না কি তুমি আমাকে বোঝার চেষ্টা করছ না?"

— "বোঝার চেষ্টা করি, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারি না।"

— "তাহলে আর আমাদের সম্পর্ক রাখার মানে কী?"

মাইনুদ্দীন স্তব্ধ হয়ে গেল।

বেশ কয়েকদিন যোগাযোগ ছিল না। মাইনুদ্দীন চেষ্টার পর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু রিমো সাড়া দেয়নি।

এক সন্ধ্যায় হঠাৎ রিমোর নাম্বার থেকে ফোন এল।

— "তুমি কেমন আছ?"

— "ভালো না।"

— "কেন?"

— "কারণ তুমি নেই।"

রিমো কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, "আমি আসলে এখন আর আগের মতো অনুভব করি না, মাইনুদ্দীন। আমাদের সম্পর্কটা যেন একটা বোঝা হয়ে গেছে। আমি কার সাথে মিশব, কার সাথে কথা বলব, সেটা তুমি ঠিক করে দেবে, এটা আমি চাই না।"

— "তুমি তাহলে চলে যেতে চাও?"

— "আমরা একসাথে থাকলে দুজনেই কষ্ট পাব, তাই হয়তো এটাই ভালো।"

মাইনুদ্দীনের বুকের ভেতরটা ধ্বংসস্তূপের মতো মনে হচ্ছিল। একসময় যে মানুষটা ছিল তার পৃথিবী, সে আজ বলছে—এই সম্পর্কটা তাকে কষ্ট দিচ্ছে!

— "তুমি কি আমাকে ভালোবাসতে না, রিমো?"

— "ভালোবাসতাম। কিন্তু ভালোবাসা সবসময় একভাবে থাকে না, মাইনুদ্দীন। কিছু কিছু ভালোবাসা বাতাসে ভাসে, ধরা যায় না।"

সেদিনের পর থেকে আর কথা হয়নি তাদের।

মাইনুদ্দীন অনেকদিন অপেক্ষা করেছিল। ভেবেছিল, রিমো ফিরে আসবে। কিন্তু সে আর আসেনি।

একদিন ক্যাম্পাসে এক বন্ধুর মোবাইলে রিমোর ছবি দেখল সে। রিমো হাসছে, আরেকজন ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা তার গালে হাত রেখেছে, ছবি তুলছে।

সেদিন রাতে মাইনুদ্দীন অনেক কাঁদল।

ভালোবাসা কি তাহলে এমনই? আজ যার জন্য পৃথিবী উলটে দিতে চাও, কাল সে তোমার অস্তিত্ব ভুলে যাবে?

রিমোর জন্য তার সব ছিল সত্যি, কিন্তু রিমোর কাছে সে ছিল কেবল আরেকটা অধ্যায়।

বাতাসে ভাসা ভালোবাসা… ধরা দিল না কখনো।

মাইনুদ্দীনের জন্য দিনগুলো যেন বিষাক্ত হয়ে উঠল। ক্লাসে মন বসত না, বন্ধুরা কথা বলতে এলেও এড়িয়ে যেত। রাতে ঘুম আসত না, চোখের সামনে শুধু ভেসে উঠত রিমোর সেই হাসিমুখ—কিন্তু পাশে সে নয়, অন্য কেউ।

কিছুদিন পর বন্ধুরা জোর করে তাকে নিয়ে গেল একটা আড্ডায়। সেখানে গিয়ে হঠাৎ শুনল, কেউ একজন বলছে—

— "আরে, জানিস? রিমো নাকি আবার নতুন একটা সম্পর্কে জড়িয়েছে!"

— "আরে, ওর তো এসব পুরনো অভ্যাস! কার না কার সাথে কথা বলে, তারপর আবার ছেড়ে দেয়!"

মাইনুদ্দীনের গা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। সে কি তাহলে স্রেফ একটা সংখ্যা ছিল রিমোর জীবনে? একটা সাময়িক মোহ?

সে নিজেকে বোঝাতে চাইল, "না, রিমো এমন না। ও আমাকে ভালোবাসত।"

কিন্তু মাথার ভেতর তখনও বাজছিল সেই কথাগুলো—
"ভালোবাসা সবসময় একভাবে থাকে না, মাইনুদ্দীন। কিছু কিছু ভালোবাসা বাতাসে ভাসে, ধরা যায় না।"

সময় কেটে যায়। জীবন থেমে থাকে না।

মাইনুদ্দীন ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নেয়। ক্যারিয়ারের দিকে মন দেয়, নিজেকে গুছিয়ে নেয়।

একদিন, অনেকদিন পর, হঠাৎ তার ফোনে একটা অচেনা নাম্বার থেকে মেসেজ আসে—

"কেমন আছো?"

নাম্বারটা সেভ করা ছিল না, কিন্তু মেসেজটা দেখেই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল।

রিমো!

মাইনুদ্দীন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল স্ক্রিনের দিকে। এতদিন পর রিমো কেন লিখল? কী চায় ও?

সে কিছুক্ষণ ভেবে একটা ছোট্ট উত্তর দিল—

"ভালো। তুমিও ভালো থেকো।"

আর কিছু লিখল না।

এই প্রথমবার, সত্যি সত্যিই সে বুঝতে পারল, রিমো তার অতীত। কিছু কিছু ভালোবাসা সত্যিই বাতাসে ভাসে—ধরা যায় না, আটকে রাখা যায় না।

তবে সেটার পেছনে ছুটে জীবনটা নষ্ট করাও বোকামি।

মেসেজটা পাঠিয়ে ফোনটা পাশে রেখে দিল মাইনুদ্দীন। বাইরে ঝিরঝিরে বাতাস বইছে। এবার সে আর বাতাসে ভাসা ভালোবাসার পেছনে ছুটবে না—সে নিজের জীবনের দিকে এগিয়ে যাবে।

পরের গল্প পড়তে চাইলে পড়তে পরেন

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url