একটি অসমাপ্ত চিঠি || কষ্টের গল্প বাংলা || বৃষ্টি ও প্রেমের গল্প

 

একটি অসমাপ্ত চিঠি || কষ্টের গল্প বাংলা || বৃষ্টি ও প্রেমের গল্প
একটি অসমাপ্ত চিঠি || কষ্টের গল্প বাংলা || বৃষ্টি ও প্রেমের গল্প

একটি অসমাপ্ত চিঠি

রাত ২টা বাজে। জানালার বাইরে একটানা বৃষ্টি পড়ছে। পলাশের হাতে কাঁপতে থাকা কলম, সামনে একটি চিঠি। কাগজের কোণাগুলো ভিজে গেছে, হয়তো চোখের জলেই।

"প্রিয় মেঘলা,
এই চিঠিটা হয়তো কখনোই তোমার হাতে পৌঁছাবে না। তবু লিখছি, কারণ কষ্টগুলো বুকের ভেতর পাথর হয়ে জমেছে। জানো, কিছু কিছু কষ্ট এমন, যা কাউকে বলার সুযোগ হয় না। শুধু অনুভব করা যায়, নিঃশব্দে, নিঃশেষে..."

পলাশ থেমে যায়। দীর্ঘ শ্বাস নেয়। পাঁচ বছর আগে এই শহরের বৃষ্টিভেজা এক সকালে মেঘলার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল। মেঘলা ছিল মুক্ত বাতাসের মতো— চঞ্চল, স্বাধীন। আর পলাশ? সে ছিল স্থির এক গাছের মতো, যার ছায়ায় মেঘলা ক্লান্ত হলে এসে বসতো, আর চলে যাওয়ার সময় ঝড় তুলে দিতো।

একদিন, হুট করেই মেঘলা বলেছিল, "পলাশ, যদি আমি হঠাৎ হারিয়ে যাই, তুমি কি খুঁজবে আমাকে?"

পলাশ হেসে বলেছিল, "তুমি হারালে তো আমি নিজেকেও খুঁজে পাব না!"

কিন্তু মেঘলা সত্যিই একদিন হারিয়ে গিয়েছিল। কোনো আগাম বার্তা ছাড়াই। শুধু রেখে গিয়েছিল একটি ছোট্ট নোট— "আমাকে খুঁজতে যেও না। কষ্ট দিও না নিজেকে!"

পলাশ জানে, মানুষ কখনো কখনো হারিয়ে যায় শুধু হারিয়ে যাওয়ার জন্য নয়, বরং কাউকে কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে।

চিঠির শেষ লাইন লিখতে গিয়ে পলাশের কলম থেমে যায়। এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে কাগজের ওপর— চোখের জল, নাকি ছাদ থেকে পড়া বৃষ্টির ফোঁটা, কে জানে!

চিঠিটা শেষ হলো না। যেমন তাদের গল্পটাও শেষ হয়নি— অসমাপ্তই থেকে গেল।

একটি অসমাপ্ত চিঠি (পরবর্তী অধ্যায়)

বাইরের বৃষ্টি থামেনি। পলাশের ঘরের জানালা খোলা, বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসছে ভেজা মাটির গন্ধ। চিঠিটা টেবিলের ওপর রেখে সে উঠে দাঁড়ায়। বুকের ভেতর একটা শূন্যতা, যা কিছুতেই ভরছে না।

পাঁচ বছর ধরে মেঘলাকে খোঁজেনি সে। প্রতিদিন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে, "যদি ও চায় না খুঁজতে, তবে আমি খুঁজব না।" কিন্তু আজ, এতদিন পর কেন যেন মনে হচ্ছে, মেঘলাকে খুঁজে বের করা দরকার।

পলাশ পুরোনো ডায়েরিটা খুলে বসে। সেখানে মেঘলার শেষ স্মৃতিগুলো আঁকা আছে— কোনো এক ক্যাফের কোণে বসে মেঘলার হাতের লেখা নোট, কোনো এক বসন্ত বিকেলে তোলা হাসিমুখের ছবি, আর সেই শেষ চিঠির কাঁপা কাঁপা লাইন:

"আমাকে খুঁজতে যেও না। কষ্ট দিও না নিজেকে!"

হঠাৎ করেই তার মনে পড়ে যায়, মেঘলা একদিন বলেছিল— "যদি কখনো হারিয়ে যাই, তাহলে আমাকে খুঁজতে এসো সেই শহরে, যেখানে কেবল বৃষ্টিই কথা বলে!"

সেটা কোন শহর?

পলাশ জানে। তারা একবার একসঙ্গে গিয়েছিল সিলেটের এক পাহাড়ি গ্রামে। সেখানে প্রতিদিন বৃষ্টি হতো, আর মেঘলা বলেছিল, "এই শহরটাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি, কারণ এখানে কেউ কাঁদলেও আলাদা করে বোঝা যায় না— সবকিছুই তো ভিজে থাকে!"

পরদিন সকালে ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দেয় পলাশ।

বৃষ্টি যেখানে কথা বলে

সিলেটের ছোট্ট এক গ্রামে এসে পলাশ থামে। চারদিকে কুয়াশা, পাহাড়ের গায়ে গাঢ় সবুজ। একটা পুরোনো কফিশপে ঢুকে সে। চারপাশে তাকিয়ে মেঘলাকে খোঁজে, কিন্তু মেঘলা কোথাও নেই।

ক্যাফের এক কোণে বসে থাকা এক বৃদ্ধা হেসে বলে, "তোমার চোখে খুঁজে ফেরার যন্ত্রণা আছে, ছেলে। তুমি কি কাউকে খুঁজছ?"

পলাশ চমকে তাকায়। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, "হ্যাঁ। আমি মেঘলাকে খুঁজছি।"

বৃদ্ধা মৃদু হেসে বলে, "সে তো প্রতিদিন এখানে আসে, ঠিক এই কোণায় বসে বৃষ্টি দেখে। কিন্তু আজ এল না।"

পলাশের বুক ধক করে ওঠে। তবে কি মেঘলা সত্যিই এখানে আছে?

সে তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে আসে, চারদিকে তাকায়। দূরে, বৃষ্টিভেজা রাস্তার ধারে, একটা ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছে কেউ। পলাশ দৌড়ে যায়।

কাছে যেতেই মেঘলার চেনা কণ্ঠ শোনা যায়— "তুমি এসেছো?"

পলাশ থেমে যায়। পাঁচ বছর পর সেই চেনা চোখের দিকে তাকিয়ে সে শুধু একটাই প্রশ্ন করে— "কেন চলে গিয়েছিলে?"

মেঘলার চোখে জল। সে শান্ত গলায় বলে, "কারও জীবনে থেকেও যদি কষ্টের কারণ হয়ে যাই, তাহলে দূরে চলে যাই। তোমার সুখের জন্যই গিয়েছিলাম, পলাশ!"

পলাশ হাসে, কষ্টের হাসি।

"তুমি কি জানো? তুমি হারিয়ে যাওয়ার পর, আমার সব সুখও তোমার সঙ্গে চলে গিয়েছিল!"

মেঘলার চোখ জলে ভরে ওঠে।

বৃষ্টি ঝরতেই থাকে, তাদের চারপাশে। যেন প্রকৃতি নিজেই সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই দুজনের কষ্টের গল্পের সামনে।

গল্পটা শেষ হলো কি?

হয়তো হয়নি। হয়তো পলাশ ও মেঘলা আবার একসঙ্গে নতুন করে শুরু করবে। অথবা তারা দুজন আবার দুই দিকে হাঁটবে, বৃষ্টির ভেতরে হারিয়ে যাবে— যেমন গল্পের শুরুতে হয়েছিল।

কারণ, কিছু গল্পের শেষ হয় না। তারা শুধু থেকে যায়— অসমাপ্ত চিঠির মতো, বৃষ্টিভেজা শহরের মতো।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url